ইসিজি রিপোর্ট বোঝার উপায়

ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম বা সংক্ষেপে ইসিজি হৃদরোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত একটি পরীক্ষা। রোগীর হৃদস্পন্দনের হার ও ছন্দ পরীক্ষা করার মাধ্যমে এ পরীক্ষা সম্পন্ন হয় এবং রিপোর্ট প্রদান করা হয়। বিস্তারিত জানুন ইসিজি রিপোর্ট বোঝার উপায় এবং ইসিজি পরীক্ষা কেন করা হয়।

হার্ট অ্যাটাক, হৃদরোগ, অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন বা বর্ধিত হৃৎপিণ্ডসহ হার্ট ফেইলিওর এর বিভিন্ন কারণ শনাক্ত করতে চিকিৎসকগণ এই ইসিজি পরীক্ষা ব্যবহার করেন। ইসিজি একটি নন-ইনভেসিভ পরীক্ষা যার অর্থ হল এটি করার সময় কাটাছেঁড়া করে শরীরে কিছু প্রবেশ করাতে হয়না।

ইসিজি রিপোর্ট বোঝার উপায়

মূলত ব্যক্তির বাহু, পা এবং বুকের ত্বকের সাথে ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রোড প্যাচ সংযুক্ত করা হয় যার মাধ্যমে হৃদপিন্ডের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ রেকর্ড করে রোগ নির্ণয় করা হয়। ইসিজি একটি নিরাপদ এবং ব্যথাহীন পরীক্ষা পদ্ধতি। খুব অল্প সময়েই এই পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। আপনি যদি আপনার ইসিজি রিপোর্টের ফলাফল বুঝতে চান সেক্ষেত্রে আপনার কিছু প্রাথমিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আজকের এই লেখায় ইসিজি রিপোর্ট বোঝার উপায় সহ ইসিজি পরীক্ষা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ব্যাখ্যা করা হবে। ইসিজি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আজকের এই আলোচনা সহায়ক হবে বলে আশা করছি।

ইসিজি পরীক্ষা কেন করা হয়?

সাধারণত হৃদপিণ্ড সংশ্লিষ্ট অস্বাভাবিকতা নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকগণ ইসিজি পরীক্ষার শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। একজন চিকিৎসক যেসব কারণে ইসিজি পরীক্ষা করাতে বলেন তা হল-

  • রোগীর হার্ট অ্যাটাক শনাক্ত করতে চিকিৎসক ইসিজি করাতে বলবেন।
  • রোগীর হৃৎপিণ্ডের পেশীতে রক্ত ​​​​প্রবাহের মাত্রা নির্ণয় করানোর জন্য ইসিজি করানো হয়। , যা ইস্কেমিয়া নামেও পরিচিত।
  • হৃদপিণ্ডের যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করতে ইসিজি করতে হয়।
  • হৃৎপিণ্ডের পেশী পুরু হয়ে যাওয়া শনাক্ত করতে ইসিজি করতে হয়।
  • এছাড়া ইলেক্ট্রোলাইট স্তরের বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা শনাক্তকরণে, যেমন কম বা উচ্চ ক্যালসিয়াম মাত্রা, পটাসিয়াম মাত্রা নির্ণয়ের জন্য ইসিজি করানো হয়।

কখন ইসিজি পরীক্ষা করাবেন?

ইসিজি সাধারণত এক ধরনের মেডিকেল রিপোর্ট । কিছু বিশেষ উপসর্গ যদি কারও ক্ষেত্রে দেখা যায় তখন সেই ব্যক্তির ইসিজি পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এমন কিছু উপসর্গ নিয়ে এখন আলোচনা করা হবে।

  • আপনার যদি শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে অসুবিধা হয় সাথে বুকে ব্যথা হয় তাহলে ডাক্তার আপনাকে ইসিজি করানোর পরামর্শ দিবেন।
  • হালকা মাথাব্যথা, এবং মাথা ঘোরার মতো অনুভূতি হলে
  • উচ্চ পালস রেট
  • ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং ব্যায়াম করার ক্ষমতা হ্রাস পেলে তা হৃদপিণ্ডের সমস্যার কারণে হতে পারে। সেক্ষেত্রে ইসিজি করানোর দরকার হতে পারে।
  • হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলেও ইসিজি পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হতে পারে।

ইসিজি পরীক্ষার পূর্বের প্রস্তুতি

ইসিজি পরীক্ষা করার সময় আঁটোসাটো পোশাক পরিধান করা থেকে বিরত থাকুন। ঢিলেঢালা পোশাক পরে ইসিজি করাই উত্তম।

  1. ভারি শারীরিক পরিশ্রমের পরপর বা দৌড়ে, হেঁটে এসে সাথে সাথে ইসিজি করাবেন না। এ সময় হৃদস্পন্দনের হার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে এবং ইসিজি পরীক্ষায় সঠিক ফলাফল আসবেনা।
  2. সোনা,রূপা বা অন্য কোন ধাতুর তৈরি জিনিস পরিধান করবেন না। ইসিজি পরীক্ষা করানোর পূর্বে তা খুলে রাখুন।
  3. ইসিজির পূর্বে বেল্ট,রাবার এবং আংটি খুলে রাখুন।

ইসিজি রিপোর্ট বোঝার উপায়

ইসিজি পরীক্ষায় শরীরের বিভিন্ন অংশে ইলেক্ট্রোড স্থাপন করে হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক সংকেত পরিমাপ করা হয়। করে। তারপর সংগৃহীত তথ্য গ্রাফের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় যা ইসিজি রিপোর্ট নামে পরিচিত। একটি সাধারণ ইসিজি রিডিং এর রিপোর্টে P,Q, R, S, T, নামক বিভিন্ন অংশ রয়েছে যা আমাদের হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত। ইসিজি রিপোর্ট বোঝার জন্য আপনাকে এই তরঙ্গগুলোর পুনরাবৃত্তির হার, আকৃতি, সময় এবং এগুলোর মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার হার লক্ষ্য করতে হবে। একজন কার্ডিওলজিস্ট আপনার ইসিজি রিপোর্ট দেখে আপনার হৃদপিণ্ডের অবস্থা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। এরপরও সাধারণভাবে ইসিজি রিপোর্ট বোঝার কিছু উপায় রয়েছে যা নিম্নে ব্যাখ্যা করা হল।

ইসিজি চক্র

ইসিজি রিপোর্ট বোঝার জন্য প্রথমেই আপনাকে ইসিজি চক্রের তরঙ্গগুলো সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।

ইসিজি রিপোর্ট বোঝার উপায়
চিত্রঃ স্বাভাবিক ইসিজি রিপোর্টের তরঙ্গ চক্র

ছবির চিহ্নিত করা অংশে যে P তরঙ্গ দেখানো হয়েছে তা মূলত অ্যাট্রিয়াল ডিপোলারাইজেশনকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ এটি হৃদপিন্ডের উপরের দুই প্রকোষ্ঠ যা অলিন্দ নামে পরিচিত তার সংকোচন হওয়াকে বোঝায়। এরপরে QRS Complex অংশ দিয়ে হৃদপিন্ডের নিচের দুই প্রকোষ্ঠ অর্থাৎ নিলয়ের সংকোচন হওয়াকে বোঝায়। তারপর T তরঙ্গ দিয়ে নিলয়দ্বয় এর relaxation state বা শিথিল হওয়াকে বোঝায়।

P তরঙ্গের স্বাভাবিকতা পরীক্ষা

ইসিজি রিপোর্টে যদি P তরঙ্গ উপস্থিত থাকে এবং খাড়াভাবে উপরের দিকে থাকে তাহলে তা সুস্থ হৃদপিণ্ডের একটি দিকনির্দেশক।

PR interval মাপুন

ইসিজি গ্রাফ থেকে PR অংশ মাপতে হবে। একটি স্বাভাবিকভাবে কর্মক্ষম হৃদপিণ্ডে এই অংশের মান ০.১২ সেকেন্ড থেকে ০.২ সেকেন্ডের মধ্যে হবে যা ইসিজি গ্রাফের ক্ষুদ্রতম ৩ থেকে ৫টি ঘরের সমান হবে। P ও R এর মধ্যে জায়গা এরচেয়ে কম বা বেশি হলে তা অস্বাভাবিক হৃদপিণ্ডকে নির্দেশ করবে।

QRS Complex মাপুন

স্বাভাবিক হৃদচক্রের ক্ষেত্রে একটি QRS complex ২ থেকে ৩টি ক্ষুদ্রতম ঘরের সমান হবে যা ০.০৮ থেকে ০.১২ সেকেন্ডকে নির্দেশ করে।

হৃদপিণ্ডের ছন্দ মাপুন

ইসিজি রিপোর্ট বোঝার উপায়
চিত্র- স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন

ইসিজি রিপোর্টে দুটি R তরঙ্গের মধ্যে দূরত্ব লক্ষ্য করুন। সবগুলো R তরঙ্গ সমান দূরত্বে থাকলে তা স্বাভাবিক হৃদস্পন্দনকে নির্দেশ করবে। নতুবা অনিয়মিত হৃদস্পন্দনকে বোঝাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ যেমন অ্যামফিটামিন, বিটা-ব্লকার, ওটিসি কোল্ড এবং অ্যালার্জির ওষুধ এই অস্বাভাবিক হৃদপিন্ডের ছন্দ সৃষ্টি করতে পারে।

হৃদস্পন্দনের হার মাপুন

অস্বাভাবিক দ্রুত বা ধীর হৃদস্পন্দন ইসিজি করে শনাক্ত করা যায়। স্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের হার প্রতি মিনিটে ৭৫ বিট। ইসিজি রিপোর্ট থেকে ৬ সেকেন্ডে যে কয়টি R তরঙ্গ সংঘটিত হয়েছে তার সংখ্যাকে ১০ দিয়ে গুণ করে অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের হার নির্ণয় করা যায়।

সাধারণ জিজ্ঞাসা / FAQ

ইসিজি করানোর সময় কি বৈদ্যুতিক শক পাওয়ার ঝুঁকি আছে?

ইসিজি একটি সম্পূর্ণ নিরাপদ পরীক্ষা পদ্ধতি। ইসিজি করানোর সময় বৈদ্যুতিক শক পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই পরীক্ষায় ব্যবহৃত ইলেকট্রোডগুলো শুধুমাত্র আপনার হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করবে। ইলেক্ট্রোড থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়না।তাই আপনি কোনো রকম  বৈদ্যুতিক শক পাবেন না।


হার্ট অ্যাটাক নির্ণয়ের জন্য ইসিজি কতটা সঠিক?

হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হলে হৃদপিণ্ডে রক্ত ​​​​সরবরাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় বা সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ হয়। ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম বা ইসিজি পরীক্ষার মাধ্যমে হার্টের বৈদ্যুতিক ক্রিয়াকলাপ পরিমাপ করে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়।

ইসিজি রিপোর্ট এর তরঙ্গগুলোর প্যাটার্ন হার্ট অ্যাটাকের পূর্ববর্তী বা সম্ভাব্য প্রমাণ প্রদর্শন করে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক হলে তা ইসিজি পরীক্ষাতে ধরা নাও পড়তে পারে। যেমন অ্যাসিম্পটোমেটিক হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে ইসিজি রিপোর্ট স্বাভাবিক আসতে পারে। তাই বুকে ব্যথার উপসর্গ থাকা অবস্থাতেও ইসিজি রিপোর্ট স্বাভাবিক এলে একক ইসিজি না করিয়ে নিশ্চিত হবার জন্য এক বা দুই ঘণ্টা পরপর ইসিজি করাতে হবে।

উপসংহার

একজন চিকিৎসক যদি রোগীর ক্ষেত্রে হৃদপিণ্ডের কোনো অস্বাভাবিকতা সন্দেহ করেন সেক্ষেত্রে ইসিজি পরীক্ষা করতে বলেন। বিভিন্ন ধরনের ইসিজি পরীক্ষা করা যেতে পারে যেমন স্ট্যান্ডার্ড ইসিজি, হোল্টার মনিটর, ইভেন্ট মনিটর ইত্যাদি। যদি আপনার ইসিজি পরীক্ষার রিপোর্টে কোনো অস্বাভাবিকতা আসে, তাহলে বিচলিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করুন এবং প্রয়োজনীয় পন্থা অনুসরণ করুন। আশা করি, উপরোক্ত লেখায় বর্ণিত ইসিজি রিপোর্ট বোঝার উপায় আপনার ইসিজির রিপোর্ট বোঝার ক্ষেত্রে উপকারী ভূমিকা রাখবে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *